কবি আবুল হোসেন সরকার : ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-জীবনবোধ
গোলাম সারোয়ার সম্রাট
ঠাকুরগাঁওয়ের লোক ভাষায় সংগীত ও কবিতা রচনায় কৃতিত্ব অর্জনকারী কবি আবুল হোসেন সরকার এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ( জন্ম : ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর। মৃত্যু ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর ) স্কুল জীবন শেষ করে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তাঁর মফস্বলমুখীতা এবং লোক ঐতিহ্য খোঁজার মর্মমূলে ছিল একধরণের স্বভাবজাত গ্রামীণ চেতনা। ব্যক্তিভেদে মননের যে কথা আমরা ভাবি, সে দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি তীক্ষ্ম মেধা আর আদর্শবাদী চেতনার মানুষ। সেই মেধা পেয়েছিলেন হয়তোবা ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামীণ আবহ থেকে। ব্যক্তিত্ব জুড়ে ছিল সরল এক নিঃশব্দ শীতলতা। সে জন্যই সমাজকে খুব বেশী পরোয়া না করে নিজের মনে কাজ করেছেন। উদার সৃষ্টিশীল হতে পেরেছিলেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে। তাই ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র দৈনিক বাংলাদেশর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই পত্রিকা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
সম্ভবত এসব প্রেষণা থেকে তিনি স্বাধীনতার পরপরই লিখেছেন, গাঁয়ের গান (১৯৭২-৭৩) প্রথম-দ্বিতীয় খণ্ড। জীবন দর্শন নিয়ে , শিখা চিরন্তন (২০০১), দুঃসময়ের পদাবলী (২০০৬), হামারগাঁও ঠাকুরগাঁও’ (২০০৯), মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি (২০১০), খোকা-খুকুর বঙ্গবন্ধু (২০১০), রক্তে লেখা স্বাধীনতা (২০১০)। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৯।
তাই যেমন গাঁয়ের জীবনকে খুব আপন করে মানুষ এবং ষড়ঋতুকে আত্মস্থ করে লিখলেন জীবনের তামাটে গীতিকাব্য, তেমনই বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর পেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম-প্রকৃতি, স্বভাবজাত দুরন্ত বসন্ত যৌবনকে বিন্যস্ত করে লিখেছেন বর্ণিল চিত্র ভাষ্যে।
কবিতায় আবুল হোসেন সরকার যতটাই স্বাভাবিক, অন্তঃগত ও ছান্দিক আবেগী, গদ্যে ততটা তিনি বুদ্ধি আর রাজনীতি নির্ভর এবং যৌক্তিক। তাই স্বাভাবিক ভাবেই পদ্যে বা কাব্যে কবি বেশী সার্থক। তাই পদ্য বা কবিতাতেই কলম চালাতে সিদ্ধহস্ত ও সুবিন্যস্ত। অন্যপক্ষে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবন্ধ রচনায় বা গদ্য সৃষ্টিতে প্রয়োগ করেছেন বাস্তবিক জীবনের কঠিন সর্বস্বতা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কঠিন সময় ও সমকালীন আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাঁকে আরো বেশী জীবনবাদী করেছিল। তিনি কবিতা লিখতে লিখতে সামাজিক কাজ-কর্মে জড়িয়ে পড়েন। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে সমাজ উন্নয়ন নিয়ে আরো বেশী মনযোগী হন। মানব কল্যাণের কাজে সময় ব্যয় করেন। আর্থিক রোজগারের চিন্তা না করেই বেছে নেন অলাভজনক উন্নয়ন কর্মপদ্ধতি।
এসবের পাশাপাশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি বঙ্গবন্ধুর দলীয় রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আবুল হোসেন সরকার লেখা-পড়া শেষ করে সাহিত্যের অধ্যাপক হন। কিন্তু রক্তে যে আদর্শের বীজ নিহিত ছিল, সে গণ্ডির মধ্যে বসবাস করেছেন আমৃত্যু। ব্যক্তিত্বের সেই কঠোর দামামা আর মানবিক রোম্যান্টিকতা তাঁকে কবি উপাধী দিয়েছিল।
তবে বলা যায়, কবি সত্তার পাশাপাশি শিক্ষক সত্তাকেও লালন করেছিলেন তিনি। তাই শিক্ষা নিয়ে গভীর অভিনিবেশী হয়ে সাধারণ গণমানুষের উচ্চ শিক্ষার চিন্তায় আত্মনিয়োগ করেন। শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার এই অনুপম স্বপ্নের সারথী করলেন বর্তমান আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ঠাকুরগাঁও-১ আসনের এমপি এবং তৎকালীন এমপি রমেশ চন্দ্র সেন মহোদয়কে। আবুল হোসেন স্যারের সঙ্গে পথ চলতে রাজী হলেন সাবেক শিক্ষক এমপি রমেশ চন্দ্র সেন। ১৯৯৬ সালে শহরের উপকণ্ঠে বরুণাগাঁও এলাকায় আবুল হোসেন সরকার কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন এমপি। স্বহস্তে এঁকে দিলেন বন্ধুত্ব রক্ষার অনিমেষ স্বাক্ষর।
আবুল হোসেন সরকার সকল প্রকার লৌকিক প্রাপ্তি এবং ভোগবাদী জীবন বাদ দিয়ে যেন এক সুবিশাল হৃদয় নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করেছিলেন। এলাকার সন্তানের শিক্ষার উন্নয়নে নিজের সময় ব্যয় করে জীবনী শক্তি খরচ করে দাঁড় করালেন আবুল হোসেন সরকার ডিগ্রি কলেজ নামে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সাহিত্যিক-কবি অধ্যাপক আবুল হোসেন সরকার আকষ্মিক ভাবে চির বিদায় নিয়েছিলেন হজ পালন করতে গিয়ে। মৃত্যু বরণ করেন ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ০৮ অক্টোবর । হঠাৎ করে এই প্রয়াণ আমাদের হতবিহব্বল করেছিল। কারণ আমরা যারা তাঁর অনুসারী ছিলাম বা ছিলাম ঘনিষ্ট শিষ্য তারা কবির ফিরে আসবার অপেক্ষায় ছিলাম। কখন ফিরে এসে ফোন করে বলবেন – চলো আগামী সপ্তাহে ওমুক অনুষ্ঠানে। কারণ তাঁর সৃষ্ট সমাজকল্যাণধর্মী ও সাহিত্য কর্মের পরিচিতির কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন সাহিত্য-সামজিক সংগঠন তাঁকে সম্মাননা দিতেন। খুব সাধারণ এবং ফুরফুরে মানসিকতার এই মানুষটি অসুস্থ্য শরীর নিয়েও পঞ্চগড় থেকে রাজশাহী এবং ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করতেন। বেশ কয়েক জায়গায় তাঁর সফর সঙ্গী হতে পেরেছিলাম। আবুল হোসেন স্যারের কাছ থেকে শেখার অনেক ছিল। বিশেষ করে তাঁর সময়জ্ঞান এবং ধৈর্য।
সারাজীবন সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং শিক্ষা বিস্তারই ছিল যাঁর সাধনা। তিনি শিক্ষা বিস্তারে নিজের সম্পত্তির একটি বড় অংশ বিসর্জন দিয়েছেন। ইচ্ছে করলেই দশজনের মত বহুতল ভবন নির্মাণ করে গাড়ি-বাড়ি করে আরাম-আয়েশে জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে রুহিয়া ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। কিন্তু বাসে নয়, সাইকেল নিয়ে কলেজ করতেন। পরে রোড ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। সেসময়ে আয়-রোজগার থাকলেও নিজের জন্য মোটর বাইক কেনেন নি। শহর থেকে অটো বা রিকসায় যাতায়াত করতেন। যে অর্থ ব্যয় করেছেন নিজের স্বপ্নের মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়। তিনি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভূক্ত গীতিকার ছিলেন ।
শিক্ষাব্রতী মুক্তিযোদ্ধা কবি আবুল হোসেন সরকারের জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা করা বেশ কঠিন। তার শিক্ষা ভাবনা এবং সাহিত্য রচনা সর্বোপরি ঠাকুরগাঁওয়ের প্রকাশনার জগৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে বিস্তারিত না বললে অসম্পন্ন থেকে যায়। যা ছোট্ট কোন পরিসরে সম্পূর্ণ রূপ দেয়া বেশ কঠিন। তবুও কিছুটা আংশিক হলেও তাঁর জীবন ও চিন্তা সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
—-///—-